
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর উত্তর মাদারশা গ্রামের বদিউল আলম হাট।এখানেই জন্ম নেন আবু মমতাজ সাদ উদ্দীন আহমেদ কিসলু—যিনি একাধারে খেলোয়াড়, কোচ,সংগঠক এবং বর্তমানে সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও বিআরটির চেয়ারম্যান।
কিসলুর শৈশব কেটেছে ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনীতে।তার পিতা ম্যাজিস্ট্রেট জালাল আহমেদ ছিলেন ব্রিটিশ,পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের এক দায়িত্বশীল,সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ম্যাজিস্ট্রেট।মা মমতাজ বেগমের স্নেহশীলতা ও পরিবারের মূলমন্ত্র“খেলার সময় খেলা,পড়ার সময় পড়া”—শিশু কিসলুর জীবনদর্শনকে গড়ে দেয়।
আজিমপুর ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে পড়াকালীন তিনি প্রায় প্রতিদিন ছুটে যেতেন আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারে।সেখানে মাত্র দুটি টেবিল থাকলেও প্রতিযোগিতা ছিল প্রচণ্ড।ছোট্ট কিসলুর স্বপ্ন ছিল একদিন চ্যাম্পিয়ন হয়ে নাম্বার ওয়ান টেবিলে খেলা। ১৯৭৬ সালে প্রথম ওপেন টুর্নামেন্ট জিতে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়।
পরের বছর,১৯৭৭ সালে,ঢাকার টিটি লিগে তার আনুষ্ঠানিক অভিষেক ঘটে।এরপর থেকে শুরু হয় এক দীর্ঘ প্রতিযোগিতামূলক ক্যারিয়ার।ইয়াং প্যাগাসাস, আরইবি,আরমানিটোলা জেএস,মোহামেডান স্পোর্টিং, আনসার,বিটিএমসি,ইন্টার স্পোর্টস—একাধিক ক্লাবের হয়ে খেলেছেন তিনি।
খেলাধুলায় তার সাফল্য ছিল অনেক যথাক্রমেঃ
জাতীয় এককে দুইবার চ্যাম্পিয়ন,একাধিকবার জাতীয় ও মেট্রোপলিটন লিগে দলগত ও দ্বৈত চ্যাম্পিয়ন,১৯৮২ সালে চট্টগ্রামে শুভকরণ রাজগোরিয়া মেমোরিয়াল টুর্নামেন্টে একক ও দ্বৈত চ্যাম্পিয়ন,১৯৮৮ সালে জাতীয় টেবিল টেনিসে একক,দ্বৈত ও মিশ্র দ্বৈতে সাফল্য।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এশিয়ান ওয়ার্ল্ড টিটি চ্যাম্পিয়নশিপ,সাফ গেমসসহ নানা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে,তবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ—১৯৮৯ সালে জাতীয় টুর্নামেন্টে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন সেমিফাইনালে রচির কাছে হেরে হাতছাড়া হয়।
খেলোয়াড়ি জীবনের পাশাপাশি স্কুলে পড়াকালীনই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আজিমপুর ইয়ং স্টার টেবিল টেনিস ক্লাব।সেখানে নিজে খেলেছেন,আবার শতাধিক খেলোয়াড়ও গড়ে তুলেছেন।আখলাক,বাদল,রিপন, রিমনসহ অনেকেই জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য পেয়েছেন তার হাত ধরে।
“ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনে হয়তো তিনি একমাত্র খেলোয়াড়, যে নিজে খেলে আবার ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে কোচিং দিয়ে নতুন খেলোয়াড় তৈরি করেছেন।
কিসলুর বাবা-মা রেখে গেছেন আট ছেলে ও চার মেয়ে। তাদের মধ্যে কিসলু এখন বিআরটির চেয়ারম্যান,আর তার ছোট বোন ফারজানা মমতাজ বিদ্যুৎ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।বাকিরাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
কিসলুর সহধর্মিণী ডা. শারমিন মিজান—জাতীয় চ্যাম্পিয়ন আখলাখের বোন ও একজন পিএইচডিধারী।তাদের দুই কন্যা ও এক পুত্রসন্তান।
১৯৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ক্রীড়া পুরস্কার ব্লু অ্যাওয়ার্ড,২০১৬ সালে খিলগাঁও পল্লীমা সংসদ থেকে বিশেষ সম্মাননা পুরষ্কার পান কিন্তু এত অর্জনের পরও তার আক্ষেপ—জাতীয় কোনো পুরস্কার তিনি পাননি।মাঝে মাঝে তাই নিজের কাছেই প্রশ্ন করেন—“পুরস্কারের আসলে যোগ্যতা কী?”
ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্যের পাশাপাশি কিসলু পড়াশোনাতেও ছিলেন অগ্রগণ্য।তিনি তার ছোট বোনসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে ১৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসনে যোগ দেন।সততা,নীতি ও দক্ষতায় তিনি বর্তমানে সরকারের অতিরিক্ত সচিব এবং বিআরটির চেয়ারম্যান।
আবু মমতাজ সাদ উদ্দীন আহমেদ কিসলুর জীবনকাহিনী প্রমাণ করে—খেলাধুলা শুধু বিনোদন নয়,এটি মানুষকে চরিত্রবান করে তোলে।একজন খেলোয়াড় হিসেবে শুরু,কোচ ও সংগঠক হিসেবে অবদান,আর সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব—সব জায়গাতেই তিনি সততা ও নিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
চট্টগ্রামের এই কৃতি সন্তান আজও বাংলাদেশের ক্রীড়া ও প্রশাসনে এক অনন্য গৌরব।