সাংবাদিকরাই যখন সাংবাদিকদের ঘোর শত্রু

0 ৬৮৮,০৫০

সাংবাদিকরাই যখন সাংবাদিকদের ঘোর শত্রু তখন তাদের রক্ষা করে সাধ্য আছে কার? দেশে সাংবাদিক নীপিড়ন, নির্যাতন, হয়রানির যে কোনো ঘটনার খোঁজ নিলেই দেখা যায়, এর নেপথ্যে কোনো না কোনো সাংবাদিক মূল ক্রীড়নকের ভূমিকায় রয়েছেন। কোনো সাংবাদিক দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট, স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সংবাদ লিখলেই একদল সাংবাদিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লেখক সাংবাদিককে নানাভাবে হেনস্তা করে থাকে। সাংবাদিক নামধারী ওই দালালদের কারণেই সংবাদ প্রকাশকারী সাংবাদিককে হামলা, মামলার শিকার হতে হয়, এমনকি নানা কায়দা কৌশল খাটিয়ে সাংবাদিকতার চাকরি থেকেও হটিয়ে দেয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটানো হয়। আগে এই দালালরা চক্ষু লজ্জায় হলেও চুপিসারে কাজগুলো করতো, ইদানিং তারা প্রকাশ্যেই সাংবাদিক বিরোধী ভূমিকায় আদা জল খেয়ে নামে। প্রায়ই দেখা যায়, প্রকাশিত সংবাদের বিরুদ্ধে অমুক চেয়ারম্যানের সাংবাদিক সম্মেলন। ‘অমুক চৌকিদারের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় এলাকায় তীব্র ক্ষোভ, বিক্ষুব্ধ মিছিল, সাংবাদিককে অবাঞ্চিত ঘোষণা’ ইত্যাদি শিরোনামে রীতিমত তান্ডব সৃষ্টিকারী সংবাদও প্রকাশ হতে দেখা যায় অহরহ।

সাংবাদিকতা পেশায় নেই, সাংবাদিকতা করেনও না। অন্য পেশায় কর্মরত ফেসবুক ইউজাররাও যখন তখন সাংবাদিকদের এক হাত দেখিয়ে ছাড়ছেন। নগ্নভাবে সমালোচনা করছেন। সাংবাদিকদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করছেন। সাংবাদিকদের কুকুর-বিড়ালের সাথে তুলনা করছেন ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে। এখানেও উঠে-পড়ে লাগছেন এক সময়ে সাংবাদিকতা পেশায় ছিলেন দাবি করে কিছু ফেসবুক ইউজাররা। প্রত্যেকটি পেশার স্বতন্ত্র একটি ধারা আছে। সাংবাদিকতা পেশার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাদেরও একটি পেশাগত অবস্থান আছে, আছে সামাজিক মর্যাদা। প্রকাশিত সংবাদ যে কারোর পক্ষে বিপক্ষে চলে যায়। একারণে বরাবরই সংক্ষুব্ধরা সাংবাদিকদের টার্গেট করে সময়ের অপেক্ষায় থাকেন। যখন কোন গণমাধ্যমকর্মী বিপদের সম্মুখীন হন তখনই অপেক্ষমাণ চক্রটি তার চরিত্র হরণে উঠেপড়ে লেগে যান। কি গ্রাম, কি শহর, কি রাজধানী সবখানে একই চিত্র। এ অপকর্মের প্রধান যোগান হয়ে উঠেছে নিবন্ধনহীন ইউটিউব চ্যানেল, অনলাইন ওয়েব পোর্টাল নামে গজিয়ে ওঠা তথাকথিত কিছু ডটকম।

অতিসম্প্রতি চট্টগ্রাম সীতাকুন্ড এলাকার মাইটিভি প্রতিনিধি নাসিরউদ্দিন লিটন এমনই নগ্ন আক্রমণের শিকার হয়েছেন। মাইটিভিতে সীতাকুন্ড’র বন উজাড়, বালু বাণিজ্যের নামে লুটপাট সংক্রান্ত একাধিক রিপোর্টের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হন লুটেরাচক্র। তারাই ইন্ধন দিয়ে স্বগোত্রীয় দালালদের লেলিয়ে দিয়েছে লিটনের বিরুদ্ধে। তারা নামে বেনামে বেশ কয়েকটি ফেক আইডি বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে সাংবাদিক লিটনের বিরুদ্ধে জঘণ্য সব অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। মনগড়া কুৎসা রটনা ও পেট বানানো ঘৃণ্য সব কাহিনী ছড়িয়ে লিটনের সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনকে দূর্বিষহ করে তোলা হয়েছে। অথচ সহকর্মি সাংবাদিক বন্ধুরা তার পাশে সোচ্চার ভূমিকা নিতেও যেন লজ্জা পাচ্ছেন। কী দুর্ভাগ্য! আজ যে সহকর্মি বন্ধুরা তার নাস্তানাবুদ হওয়া দেখে মুখ টিপে হাসছেন, কাল যে তিনিও অভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হবেন না এর কী কোনো গ্যারান্টি আছে?

দুদিন আগেই দেখলাম, উপজেলা পর্যায়ের একজন সাংবাদিক সাহেব “ষড়যন্ত্রকারীরা সাবধান” শিরোনামে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েই এক কর্মকর্তার পক্ষে দালালি যুদ্ধে নেমেছেন। আরেক কর্মকর্তার জন্য অন্যায় তদবিরও করেছেন ঢাক ঢোল বাজিয়েই। অথচ একজন বিপদাপন্ন সাংবাদিকের পক্ষে গোপনে সাক্ষর দিয়ে মৌণ সমর্থন জানাবে এমন সহমর্মি সাংবাদিক খুঁজে পাওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আর সাংবাদিকের পক্ষে প্রকাশ্যে স্ট্যাটাস দেয়ার কথা তো কল্পনাও করা যায় না। বরং এক সাংবাদিক আক্রান্ত হলে অন্য সাংবাদিকদের অনেকেই তাকে বিষোদগার করেন, তার বিপদাপন্নতা আরো নিশ্চিত করে ছাড়েন। সাতক্ষীরায় ভূমিদস্যু জোতদার চক্র ও পুলিশের যৌথ আক্রোশের নির্মম শিকার হলেন সাংবাদিক রঘুনাথ খা। তিনি গুম হতে হতে বেঁচে যান। অথচ একশ্রেণীর সাংবাদিক ওই অত্যাচারী চক্রের পা চাটা আজ্ঞাবহ গোলাম হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না। তারা আক্রান্ত সাংবাদিকের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তার বিরুদ্ধেই ফলাও প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকলেন। সাতক্ষীরায় কল্যাণ ব্যানার্জির মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক এখনও বেঁচে আছেন, আরো যুগ যুগ আয়ু চাই তার। তেমনি সাংবাদিকদের মধ্যে ঘর শত্রু বিভীষণ পরিস্থিতি অবসানেও তারই ভূমিকা চাই।

সাংবাদিকরা যুগ যুগ ধরেই আক্রান্ত হন, বারবারই হয়রানিতে নিস্পেষিত হন এ পেশার হতভাগারা। সুপ্রাচীন রাজ রাজা, জমিদার শাসন থেকে শুরু করে আজকের ডিজিটালাইজড সরকার ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই সাংবাদিকরা অভিন্ন স্টাইলে নির্যাতিত হয়েছে, বারবারই আক্রান্ত হয়েছে ভয়াল থাবায়। তবে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন সাংবাদিকদের ঝুঁকি ও আক্রান্তের ঘটনা ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। অনুসন্ধান করে দেখা যায়, সাংবাদিকতার ছদ্মবেশে অপসাংবাদিকতা করে বেড়ানো সংঘবদ্ধ চক্রের দৌরাত্ম্যের কারণেই প্রকৃত সাংবাদিকদের ঝুঁকির মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। অনেকটা নিজ গৃহে শত্রু বিভীষণ…এটাই সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিকতাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে, সাংবাদিককে নিরাপদ রাখতে কত শত পেশাজীবী সংগঠন গড়ে উঠেছে, সরকারি ভাবেও নানা পরিকল্পনা আঁকায় ও দৌড়ঝাপের ক্ষেত্রে কোনই কমতি নেই। কিন্তু তারপরও কী সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা নিরাপদ করা যাচ্ছে? হামলা, মামলা, হয়রানির অন্তহীন আক্রমণে পেশাদার সাংবাদিকগণ বারবারই ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে।

খেয়াল করে দেখুন, যে রিপোর্টার যত বেশি রিপোর্ট লিখবেন তার জন্য ঝুঁকির মাত্রা ততই বেশি। অপসাংবাদিকতার স্টাইলে আইডি কার্ড বুকে পিঠে ঝুলিয়ে দিব্যি দাপিয়ে বেড়ান, টুপাইস কামান, নেতা ও কর্মকর্তাদের চাটুকারিতা করে ঘুরেন ফিরেন- আপনি শতভাগ নিরাপদ থাকবেন। কিন্তু যেই মাত্র দেশ, সমাজ, জনপদ নিয়ে কিছু লিখতে চেষ্টা করবেন তখনই আপনি অনিরাপদ হতে থাকবেন।
এমনই অনিরাপদ হয়ে পড়েছেন এশিয়ান টেলিভিশনের পশ্চিম মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি সোহেল রানা। মাঝে মধ্যেই জনস্বার্থ সম্পৃক্ত দু’ চারটি প্রতিবেদন করতে দেখা যায় তাকে। অথচ এ সোহেল রানাকেই উল্টো হলুদ সাংবাদিক, অপ-সাংবাদিক, ভুয়া সাংবাদিক হিসেবে চিহ্নিত করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে স্বগোত্রীয় কিছু প্রাণী। সোহেল রানা লিখেছেন, গত ১৪/১৫ বছর ধরে আমার পায়ে পায়ে ল্যাং মেরে চলেছে। ওদের অন্যায় অত্যাচারে আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছি না। বারবার বিপদে ফেলেছে, ওরাই আমাকে মিথ্যা অস্ত্র মামলায় পর্যন্ত ফাঁসিয়েছে। এখন আরো কঠিন বিপদের আশঙ্কা বিদ্যমান…মানিকগঞ্জের ঘিওর এলাকায় ২৮/৩০ বছর আগে রামপ্রসাদ দীপুসহ হাতে গোণা ২/৩ জন সংবাদকর্মি সক্রিয় ছিলেন, এখনও আছেন। তারপরও সেখানকার একজন সংবাদকর্মির এমন গুমরে কান্না আমরা শুনতে চাই না, আশা করি শিগগিরই এ অরাজকতার অবসান ঘটবে।

লেখক : সাহসী অনুসন্ধানী সাংবাদিক সাইদুর রহমান রিমন ভাই

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!