0 ৭৮

ফয়সাল আজম অপু,বিশেষ প্রতিনিধিঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন রুটে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এমন অকেজো রাস্তাগুলোতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন লাখও মানুষ। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা। স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘদিন রাস্তাগুলোর সংস্কার না করায় এ বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সড়কের বেহালদশায় গত সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৭২ ঘন্টায় সড়ক দূর্ঘটনায় ঝরে গেছে ১৩টি তরতাজা প্রাণ। ১৩টি পরিবার স্বজন হারিয়ে পড়েছেন অথৈ অনিশ্চতায়। সড়কে নিহত ১৩ জনের মধ্যে ১জন নিহত হয়েছেন মহাসড়কে আর বাকি ১২জন নিহত হয়েছেন আঞ্চলিক সড়কে। এরমধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলার শিবগঞ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে। এতে একদিনে একসাথে প্রাণ হারান ৯ জন। এদিন ভোরে বারিকবাজার-সোনাপুর ভাঙ্গাসাকো এলাকায় ১৬ জন ধান কাটা শ্রমিক নিয়ে আসা নসিমনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়লে নয়জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় কেউ বাবা হারা, কেউ স্বামী হয়েছেন। তারা সবাই পেটের খাবারের জোগান দিতে গিয়েছিলেন ধান কাটার কাজে। তাদের অনেকেই মেহদীর দাগ এখনও শুকায়নি। মেহদী রাঙ্গা হাতেই লাশ হতে হয়েছে অনেকেই। এই দুর্ঘটনায় নিহত হন- ডিগ্রী পরীক্ষার্থী মিজানুর রহমান মিলু। নিহত ৯ জনের মধ্যে মিলুসহ তিন কিশোরের বিয়েও হয়েছিল কয়েক মাস আগে। তারা বাড়িতে নববধুদের রেখে ধান কাটার কাজে গিয়েছিলেন শিবগঞ্জে। এর মধ্যে তিন অত্মসত্বা। এই অত্মসত্বা নববধুগুলো হলো বিধবা। আর নিহত আহাদের ৪ মাসের নববধু আসমা, মিজানুর রহমান মিলুর নববধু আমেনা বেগম ও মিঠুনের নববধু হয়ে গেল বিধবা। স্থানীয়রা জানায়, মাত্র কয়েকদিন কাজ করলে সারাবছর ভাতের চিন্তা থাকে না। সেখানে যে ধান পাওয়া যায়, তাতেই অনেকের বছর চলে যায়। এমন কথা ভেবে ধান কাটার কাজে গিয়েছে তারা। এই মানুষগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিয়ের বয়স দুই-তিন মাস। তারা নববধুদের বাড়িতে রেখে মাত্র ২১দিন জন্য ধান কাটতে যান পাশের জেলাগুলোতে। এই বছর নতুন নয়, অনেক বছর ধরে পাশের জেলায় গিয়ে ধান কাটার রিতি চলে আসছে। কারো কারো বাবা-চাচারা এই ধান কটার কাজ করেছেন। এখন ছেলেরা বছর বছর ধান কাটতে যায়। এই দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে আসা এমারুল ইসলাম ও আলিম হোসন বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে ধানকাটা শেষে মজুরির দেড়’শ মণ ধান নিয়ে নসিমনযোগে চালকসহ আমরা ১৬ জন বাড়ি ফিরছিলাম। আমি ও আরেকজন সামনের সিটে বসে ছিলাম। পথে সোনাপুর গ্রামের ভাঙা রাস্তায় পৌঁছালে বামে সড়কের পাশে গর্তের পানিতে পড়ে উল্টে যায় নসিমনটি। এরআগে সোমবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ মহাসড়কের সত্রাজিতপুর ইউনিয়নের ফুলতলা মোড়ে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারালো শ্যামপুরের গোপালনগর এলাকার হযরত আলীর ছেলে সাইফুল ইসলাম বকুল। একইদিনে উপজেলার কানসাট থেকে গোমস্তাপুর আঞ্চলিক সড়কে ট্রাক্টরের ধাক্কায় আপন দুই ভাইসহ তিন জন নিহত হয়েছেন। সড়কের এমন বেহালদশ দেখতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মনাকষা থেকে সাহাপাড়া বাজার পর্যন্ত সাত কিলোমিটার, সাহাপাড়া নুরেশের বাড়ি থেকে মাসুদপুর বিওপি পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার, মনাকষা ঈদগাহ মোড় থেকে শিবগঞ্জ মনাকষা মোড় পর্যন্ত প্রায় নয় কিলোমিটার, শিবগঞ্জ ইসরাইল মোড় থেকে ধাইনগর পর্যন্ত ইউপি পর্যন্ত দশ কিলোমিটার, মনাকষা বাজার হতে বিনোদপুর খাসের হাট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার, খাসের হাট হতে কানসাট পর্যন্ত দশ কিলোমিটার, খাসের হাট চামা পাড়া হতে তেলকুপি বওপি পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার, তেলকুপি বিওপি থেকে কিরণগঞ্জ বিওপি পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার, কিরণগঞ্জ বিওপি হতে জমিনপুর পর্যন্ত তিন কিলোমিটার, কানসাট থেকে পুস্ককিনী পর্যন্ত তেরো কিলোমিটার, মনাকষা ইউপির পুঁঠির ঘাট ব্রিজ এলাকার প্রায় এক কিলোমিটার, দাইপুখুরিয়া ইউনিয়নের মফিজ মোড় পর্যন্ত তিন কিলোমিটার, শিয়ালমারা হতে মির্জাপুর পর্যন্ত আট কিলোমিটার, মুসলিমপুর হতে শান্তির মোড় পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার, চাতরা নতুন বাজার হতে চককীর্তি বাজার পর্যন্ত তিন কিলোমিটার, ধাইনগর চৈতন্যপুর বিজয় মোড় হতে নামোটোলা পর্যন্ত তিন কিলোমিটার, মহেশপুর হতে জাবড়ী পর্যন্ত দুই কিলোমিটার, চৈতন্যপুর হতে কল্যাণপুর পর্যন্ত দুই কিলোমিটার, পোলাডাঙ্গা হতে গোসাইবাড়ী পর্যন্ত তিন কিলোমিটার, বীরহুম আইয়ূব বাজার হতে ধাইনগর পর্যন্ত চার কিলোমিটার, নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের গ্রামীণ ব্যাংক হতে রশিকনগর-বাবুপুর পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটারসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের আরও প্রায় ১৭/১৮কিলোমিটার রাস্তার বেহাল হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এব্যাপারে শিবগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ বলেন, শিবগঞ্জে কাঁচা-পাকা মিলে মোট এক হাজার ২৯৩ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। এর মধ্যে পাকা রাস্তা চারশ কিলোমিটার। এ চারশ কিলোমিটার পাকা রাস্তার মধ্যে ১৩০ কিলোমিটার রাস্তা ভাঙা। এর মধ্যে ৩০ কিলোমিটার রাস্তার কাজ প্রক্রিয়াধীন। স্থানীয় সাংসদ ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল জানান, এলজিইডির আওতাধীন সড়কগুলোর অচলাবস্থার বিষয়ে কর্তৃপক্ষে জানানোর কথা স্ব স্ব ইউপি চেয়ারম্যানদের কিন্তু তারা বিষয়টি নিয়ে যথাসময়ে অবহিত না করায় এমন দূর্ঘটনা ঘটছে। তবে শিবগঞ্জের ভাঙ্গাচোরা সকল আঞ্চলিক সড়কগুলোর বিষয়ে যথাযত ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এদিকে, ৯ জন শ্রমিক নিহত হবার পর জেলা পুলিশ সুপার এএইচএম আবদুর রকিব বিপিএম পিপিএম (বার) চাঁপাইনবাবগঞ্জে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত ও ট্রাক্টর চালিত সকল প্রকার যানবাহন চলাচলে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন সময় সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ইঞ্জিন চালিত ও ট্রাক্টর চালিত সকল প্রকার যানবাহন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে প্রবেশ বা চলাচলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!