বিলুপ্ত হওয়া গাজীর গান বা গাজী পীরের বন্দনা এখনো চলে সন্দ্বীপে।

বাদল রায় স্বাধীন: গাজীর গান বা গাজী পীরের বন্দনা বাংলাদেশের ফরিদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে এক সময়ের প্রচলিত এক ধরনের মাহাত্ম্য গীতি। গাজী পীর সাহেব মুসলমান হলেও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ও ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের একটি অংশ তার ভক্ত ছিলো। আর ভক্তরাই এ গাজীর গানের আসর বসাতো। গান চলার সময় আসরে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা তাদের মানতের অর্থ গাজীর উদ্দেশ্য দান করতো। বর্তমানে এ গানের প্রচলন নেই বললেই চলে। কিন্তু সন্দ্বীপে প্রতিবছর বৈশাখ জৈষ্ঠ মাসে হঠাৎ বাড়ি বাড়ি এসে গাজীর বন্দনা গীতি গান এমন একজনের দেখা মেলে গতকাল।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় প্রতি বাড়ি বাড়ি গিয়ে আবুল হাশেম নামে এক ব্যক্তি তামার একটি খুটির মাথায় বাঁকা চাঁদ সদৃশ্য একটি পিতলের মাথায় বিভিন্ন প্রকার জরি সুতা ও সিঁদুর দিয়ে উঠানে পুঁতে দেন। বাড়ির বউ ঝিরা সেটার গোড়ালিতে এসে পানি ঢেলে প্রনাম করেন। এবং মানত করে টাকা ও চাউলের ঢালা সাজিয়ে সেখানে রাখেন এরপর গাজী তার সুরেলা কন্ঠে গানের সুরে সুরে অনেক উপদেশ বানী শুনান। তাতে সবাই আনন্দিত, পুলকিত ও আবেগ প্রবন হয়ে উঠেন।আবুল হাশেম বা গাজী আবু্ল হাসেম নামে সে ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায় তার বাড়ি সন্দ্বীপের মগধরা ইউনিয়নের পেলিশ্যার বাজার সংলগ্ন জমার বাড়ি। বছরের এই দিনে তিনি বাড়ি বাড়ি বেড়িয়ে পড়েন এই গাজির গান শুনাতে। এমনকি সন্দ্বীপের বাইরেও যেতে হয় তাকে।
কেন এ গাজীর গান,এটির উদ্দেশ্য বা মাহাত্য জানতে চাইলে তিনি বলেন সন্তান লাভ, রোগব্যাধির উপশম, অধিক ফসল উৎপাদন, গো-জাতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি এরূপ মনস্কামনা পূরণার্থে গাজীর গানের পালা দেওয়া হতো এ নিয়ে আসর বসিয়ে কিছু লৌকিক কার্যক্রমসহ গাজীর গান পরিবেশিত হতো।বর্তমানে সেভাবে কেউ আসর বসায়না বলে আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই গান পরিবেশন করি। বিনিময়ে নগদ টাকা, চাউল ও বিভিন্ন সামগ্রী দেয়। তবে এতে আমাদের পেট চলেনা। বংশানুক্রমে বাপ দাদারা করেছে বলে আমারও সেটি করতে হয়।
তিনি আরো বলেন মূল গানে প্রথমে গাজীর প্রশংসা করা হতো যেমন “পূবেতে বন্দনা করি পূবের ভানুশ্বর, এদিকে উদয় রে ভানু চৌদিকে পশর” তারপরে বন্দনা করি গাজী দয়াবান, উদ্দেশে জানাই ছালাম হিন্দু মুছলমান’ বন্দনা তথা প্রশংসার পরে গাজীর জীবন বৃত্তান্ত, দৈত্য-রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ, রোগ-মহামারী, বালা-মুসিবত, খারাপ আত্মার সাথে যুদ্ধ, অকুল সমুদ্রে ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে পুণ্যবান ভক্ত সওদাগরের নৌকা রক্ষার কাহিনী এ সমস্ত গানে বর্ণনা করি।
এছাড়া গানের মাধ্যমে তৎকালিন সমাজের বিভিন্ন অপরাধ, বিচার ও সমস্যা-সম্ভাবনা তুলে ধরা হতো। কিছু কিছু গানে দধি ব্যবসায়ী গোয়ালার ঘরে দুগ্ধ থাকা সত্ত্বেও গাজীকে না দেওয়ার শাস্তি বর্ণণা করা হতো।
একটি গানে ইতিহাস বর্ণণা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, গাজী পীর জমিদারের অত্যাচার থেকে প্রজা সাধারণকে রক্ষা করতেন। এমনকি কোনো কোনো ভক্ত মামলা জয়ী হওয়ার আশ্বাসও ছিলো একটি গানে। গানটির ছন্দ ছিলো এরকম- ‘”গাজী বলে মোকদ্দমা ফতে হয়ে যাবে। তামাম বান্দারা মোর শান্তিতে থাকিবে’” এরূপ গানে ধর্মীয় ও বৈষয়িক ভাবনা একাকার ছিলো।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে পট বা চিত্র দেখিয়ে গাজীর গান গেয়ে বেড়াতো বেদে সম্প্রদায়ের একটি অংশ। তার মধ্যে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফরিদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও সিলেট, নরসিংদী অঞ্চলেই এমন বেদেদের বিচরণ ছিল বেশি। এ সম্প্রদায়ের মানুষ গ্রামে গ্রামে গিয়ে গাজীর গান গেয়ে ধান অথবা টাকা নিতো, যা দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। এভাবে করে একসময় গাজীর গান বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে যায়।গাজীর গান গাওয়ার সময় ছিল কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস। যে সময় কৃষকের উঠোনে ধান থাকে। অন্য সময় কখনোই বেদেদের গাজীর গান গাইতে দেখা যেতো না। গাজীর পটের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রবাদ আছে ‘অদিনে গাজীর পট’। সঠিক সময় ছাড়া বা অসময়ে কেউ কিছু করলে এই প্রবাদটি বলা হতো।
এছাড়াও গাজীর পট গান বা চিত্রভিত্তিক গানের আসরে কারবালার ময়দান, কাশ্মীর, মক্কার কাবাগৃহ, হিন্দুদের মন্দিরের মতো পবিত্র স্থানগুলো বিশেষ চিহ্নে আঁকা থাকতো। অনেক সময় এসব চিহ্ন মাটির সরা বা পাতিলেও আঁকা হতো। পট হচ্ছে মূলত মারকিন কাপড়ে আঁকা একটি চিত্রকর্ম, যা প্রস্থে চার ফুট, দৈর্ঘ্যে সাত-আট ফুটের মতো। মাঝখানের বড় ছবিটি পীর গাজীর। তার দুই পাশে ভাই কালু ও মানিক। গাজী বসে আছে বাঘের ওপর। এই ছবিটি কেন্দ্র করে আরও আছে কিছু নীতি বিষয়ক ছবি বা চিত্র। মনোরম ক্যানভাসের এ পটটির বিভিন্ন অংশের ছবি লাঠি দিয়ে চিহ্নিত করে গীত গাওয়া হয়। গানের দলে ঢোলক ও বাঁশিবাদক এবং চার-পাঁচজন দোহার থাকতো। এদের দলনেতা গায়ে আলখাল্লা ও মাথায় পাগড়ি পরিধান করে একটি আসা দন্ড হেলিয়ে-দুলিয়ে এবং লম্বা পা ফেলে আসরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে গান গাইতো। আর দোহাররা মুহুর্মুহু বাদ্যের তালে তালে এ গান পুনরাবৃত্তি করতো।
মুলত আকাশ সংস্কৃতি ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের মাঝে এটির আবেদন দিন দিন কমে এসেছে, এবং মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা দিন দিন কঠিন হয়ে যাওয়ার কারনে এটি এখন একেবারে বিলুপ্ত প্রায় বলা চলে। তবে গ্রামের বয়োবৃদ্ধ ও সংস্কৃতি কর্মীরা এসমস্ত গানের পালা গুলোকে পৃষ্টপোষকতা করে টিকিয়ে রাখা জরুরী বলে মনে করছেন। এজন্য বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান বা বিভিন্ন ক্লাব ও ধনাঢ্যরাও এগিয়ে আসা উচিত বলে তারা মনে করেন।
Comments (০)
Add Comment