চট্টগ্রাম মেডিকেলে ১৬ ঘন্টা উপোস করেও অপারেশন হয়নি ৪ বছরের শিশুর।

0 ৫১০,২৩০

‘আম্মু-আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে, আমাকে পানি দাও,কিছু কিনে দাও,আমি কিছু খাব’। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ(চমেক)হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারের ওয়েটিং রুমের ভেতর চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলেছিল ৪ বছর বয়সী এক ছোট্ট শিশু।

একটানা ১৬ ঘন্টা উপোস থাকার ধকল সইতে না পারা ছোট্ট শিশুটির এমন চিৎকার-আহাজারি উপস্থিত ডাক্তাররা দেখেছেন,শুনেছেন।কিন্তু কারও মনে এক ফোঁটা মায়া তো হয়নি,উল্টো অপারেশন না করিয়ে শিশুটির অভিভাবকদের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে চমেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারী ওয়ার্ডের ডাক্তারদের বিরুদ্ধে।

ভুক্তভোগী শিশুটির নাম তরিকুল ইসলাম।সে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের পশ্চিম নিশ্চিন্তাপুর গ্রামের নুরুল ইসলাম ও রিজু আকতার দম্পতির প্রথম সন্তান।বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করতে গিয়ে পা ভেঙে যায় তরিকুলের।নগরীর একটি হাসপাতালে সেই পায়ে রড পড়ানো হয়েছিল।গত ৯ই সেপ্টেম্বর ভাঙা পায়ে পড়ানো সেই রড খুলতে তরিকুলকে চমেক হাসপাতালের ২৬নং অর্থোপেডিক সার্জারী ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়।এরপর অপারেশনের সিরিয়াল পাওয়ার প্রহর গুনছিলেন তরিকুলের মা-বাবা।

অবশেষে ১৭ই অক্টোবর সকাল আটটায় অপারেশন করার কথা জানানো হয় তাদের।সকাল আটটায় অপারেশন হওয়ার কথা থাকলেও দুপুর দুইটা গড়ালেও অপারেশন হয়নি।দুই দফায় দীর্ঘ ২৮ দিন হাসপাতালে ভর্তি থেকেও ছেলের অপারেশন করাতে না পারায় ছেলেকে নিয়ে হাসপাতাল ছাড়েন বাবা নুরুল ইসলাম ও মা রিজু আকতার।

নুরুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন,প্রায় এক মাসের বেশি সময় ছেলের অপারেশনের জন্য চমেক হাসপাতালে যাতায়াত করেছি।এ বিল্ডিংয়ে গেলে বলে ওই বিল্ডিংয়ে যান।এ পরীক্ষা,ওই পরীক্ষা,পাঁচতলা থেকে তিনতলা,চারতলা,একতলা,রিপোর্ট দেখানোর জন্য পাঁচতলা,এভাবে আমার দুই বাচ্চাকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি।তারওপর তারা জায়গায় জায়গায় টাকা নেওয়ার ফাঁদ বসিয়ে রেখেছে,একবার পরীক্ষা দিয়ে রিপোর্ট আনতে গেলে বলে পরীক্ষা হয়নি আবার সেই পরীক্ষা রাঙ্গুনিয়ার রোয়াজার হাট থেকে করে আনলাম।পরে আবার রিপোর্টটা দেখাতে মেডিকেলে গেলাম,এত কষ্ট করেছি শুধুমাত্র ছেলেটার অপারেশনটা যদি করাতে পারি।

তিনি আরও বলেন,দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে হাসপাতালের একটা বেডে থাকা কত যে কষ্ট সেটা আমি জানি।এমন অবস্থায় সোমবার সকাল ৮টায় অপারেশন হবে বলে রাত ১২টার পর কিছু না খাওয়াতে নিষেধ করেন ডাক্তার।বাচ্চা রাত ১০টায় ঘুমিয়ে পড়েছিল,তখন থেকে উপোস ছিল।অন্যদিকে সারারাত চেষ্টা করে আমি ব্লাড ম্যানেজ করেছি।আমার স্ত্রীও সারারাত ঘুমাতে পারেননি।সকাল ৭টায় ক্যানুলা লাগানো হাতে,গায়ে কোন কাপড় না রেখে ছেলেকে নিয়ে যাওয়া হয় অপারেশন রুমে।সকাল ৮টায় অপারেশন হওয়ার কথা বললেও দুপুর ২টার দিকে এসে তারা বললেন, আপনার ছেলের অপারেশন হওয়ার সম্ভাবনা কম।

এর আগে সকাল থেকে কান্না করছিল আমার ছেলে। বলছিল পানি দাও,কিছু কিনে দাও,আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে,আমি কিছু খাব।আমাদের আরেকটা সন্তান রয়েছে।যার বয়স ২ বছর।সে হাসপাতালে ছিল। সে চিপস,দুধ খাচ্ছে তা বড় ভাই তরিকুল দেখেও কিছুই খেতে পারছে না।কিন্তু কেন খেতে পারছে না তা বুঝতেছে না,শুধু কাঁদতে কাঁদতে খাবার দিতে বলছে। তার চিৎকার,কান্না,অপারেশন থিয়েটারে থাকা ডাক্তাররা দেখেছেন,তবু তাদের মায়া হয়নি।ওখানে অপারেশনের রোগীর কোন সিরিয়াল আমি দেখিনি, ডাক্তাররা যাকে বলে আয়া,নার্সরা তাকে নিয়ে আসে।

নুরুল ইসলাম আরও বলেন,আমি যখন ডাক্তারদের বললাম,আপনারা অপারেশন না করলে আগে বলেননি কেন?আমার ছেলেটা এত কান্না করেছে অপারেশন থিয়েটারের ওয়েটিং রুমের ভেতর।আপনারা তো দেখেছেন।তখন ডাক্তার আমাকে ভদ্র ভাষায় বললেন, আপনাকে তো কেউ এখানে দাওয়াত দেয়নি।এ কথা শুনে অপারেশনের জন্য কেনা প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রী ফেরত দিয়ে হার মেনে চলে আসলাম।আমার টাকা,সময়,আর কষ্ট সব তারা মাটি করে দিল।আমি ধিক্কার জানাচ্ছি,চট্টগ্রাম মেডিকেলের আর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের ডা. আবদুর রব ফয়সাল ও ডা. সাহেদসহ ১৭ই অক্টোবর অপারেশন থিয়েটারে দায়িত্বরত সকল ডাক্তারদের প্রতি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের ডা. আবদুর রব ফয়সালের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।

৪ বছরের শিশুকে ১৮ ঘন্টা উপোস রেখেও অপারেশন না করার অভিযোগের বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান প্রতিবেদককে বলেন, ওইদিন অপারেশনের একটা কেইসে অনেকক্ষণ সময় লেগেছিল,আইসিইউতে নিয়ে ঠিকঠাক করতে হয়েছিল,যার জন্য যিনি তরিকুলের অপারেশনটি করবেন বলে কথা ছিল,তিনি আর পারেননি।তিনি সম্ভাব্য আরেকটি তারিখ জানিয়ে দিয়েছিলেন।

‘আপনাকে কেউ দাওয়াত দেয়নি’ডাক্তারের এমন মন্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন,আমাদের বাঙালি চরিত্রে কিছু সমস্যা তো আছেই।আমরা তো আসলে কথা বলতে জানি না।আমাদের লোকজন থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা পর্যন্ত এ ধরণের কথাবার্তা বলে ফেলে। যদি এভাবে বলে থাকে,তাহলে তা অবশ্যই অপ্রত্যাশিত।আর এ রোগী যদি হাসপাতালে থাকে তাহলে পরবর্তী সময়ে আমরা অবশ্যই অপারেশন করে দেব।

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!