দীর্ঘ ২৪ বছর পর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কামাল হোসেনকে গ্রেফতার করে র‍্যাব।

0 ৫০৯,৮৩২

নগরের ডবলমুরিং এলাকায় এসিড নিক্ষেপের ২৪ বছর পর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কামাল হোসেন প্রকাশ বালু কামাল প্রকাশ শান্তকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব।

র‌্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক নুরুল আবছার জানান,ডবলমুরিং এলাকায় ১৯৯৮ সালে বন্ধুকে এসিড নিক্ষেপের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি কামাল হোসেন প্রকাশ বালু কামালকে দীর্ঘ ২৪ বছর পর চাঁদপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।কামাল হোসেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার কাউনিয়া এলাকার রসুল করিমের ছেলে।

শনিবার(১লা অক্টোবর)সকাল ১১টায় র‌্যাব-৭ এর চান্দগাঁও ক্যাম্পে চট্টগ্রাম মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফ করেন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ।

এসময় তিনি বলেন,ভিকটিম হাফেজ মোহাম্মদ জাকারিয়া কোরআনের হাফেজ ছিলেন।তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হতে চেয়েছিলেন।

এ লক্ষ্যে তিনি দূর সম্পর্কের আত্মীয় রফিকের আগ্রাবাদ কমার্স কলেজের বিপরীত পাশে অবস্থিত দি মেট্রো রেফ্রিজারেশন নামক দোকানে ফ্রিজ মেরামতের কাজ শুরু করেন।ওই দোকান রফিক ও তার বন্ধু শাহজাহান(আসামি কামালের বড় ভাই)এর অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো।

রফিকের ছেলে-মেয়েদের আরবী পড়াতেন জাকারিয়া এবং এলাকার অনেক শিশুকে পবিত্র কোরআন ও ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন।আসামি কামালও ওই দোকানে কাজ করতো।জাকারিয়াকে সবাই পছন্দ ও সম্মান করার বিষয়টিও কামালের ভাল লাগতো না।রফিক একপর্যায়ে দোকান বিক্রয়ের কথা ভাবলে হাফেজ জাকারিয়া দোকান ক্রয়ের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। এজন্য কামাল জাকারিয়ার সঙ্গে প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া করতো।

তিনি জানান,ঘটনার পূর্বের দিন দোকান মালিকের অবর্তমানে জাকারিয়া এবং কামাল দোকান খুলে কিছুক্ষণ কাজ করার পর উভয়ের মধ্যে ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে কামাল দোকান থেকে বের হয়ে যায়। ১৯৯৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর হরতালের দিন দোকান বন্ধ ছিল।এদিন আসামি কামাল জাকারিয়াকে জরুরি কথা আছে বলে দোকানে আসতে বলে।জাকারিয়া দোকানে আসার পর কামাল সকাল ৯টার দিকে মগে করে এসিড নিয়ে এসে জাকারিয়াকে বলে তোর জন্য চা এনেছি,চা খা।কিন্তু জাকারিয়া চা খেতে অস্বীকার করে।এতে কামাল ক্ষিপ্ত হয়ে মগভর্তি এসিড জাকারিয়ার মুখে নিক্ষেপ করে।এতে জাকারিয়ার চোখ,মুখ,বুক,হাত ঝলসে যায়।এসিড নিক্ষেপের পর জাকারিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করতে কামাল দিয়াশলাই দিয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পা দিয়ে কয়েকটি লাথি দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ আরও জানান, গুরুতর আহত জাকারিয়ার চিৎকারের আশেপাশের লোকজন এসে প্রায় মৃত অবস্থায় তাকে দেখতে পেয়ে ডবলমুরিং থানায় সংবাদ দেয়।ডবলমুরিং থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে জাকারিয়াকে মৃত মনে করে থানায় নিয়ে যায়।থানায় নিয়ে যাওয়ার পর ডিউটিরত প্রহরী হঠাৎ লক্ষ্য করেন,জাকারিয়ার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। পরবর্তীতে ডবলমুরিং থানা পুলিশ গুরুতর আহত জাকারিয়াকে পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যায়। টানা চারদিন সেখানে হাফেজ জাকারিয়াকে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।চারদিন পর তার জ্ঞান ফিরে।কিন্তু চোখ ও শরীর এসিডে ঝলসানোর ভয়াবহতা দেখে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে হাফেজ জাকারিয়া সর্বপ্রথম আয়নায় নিজের বিভৎস চেহারা দেখে অজ্ঞান হয়ে যান এবং ৩০ দিন কোমায় ছিলেন।পরবর্তীতে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।এসিডে জাকারিয়ার এক চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর তিনি সৌদি আরব চলে যান।

এ ঘটনায় তার বাবা মোহাম্মদ ইউনুস মিয়া বাদী হয়ে পরদিন ১৯৯৮ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর ডবলমুরিং থানায় মামলা দায়ের করেন।ঘটনার পর হতে থানা পুলিশ পলাতক আসামি কামালকে গ্রেফতারের জন্য অনেকবার অভিযান পরিচালনা করলেও ধূর্ত কামালকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।

দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়।গত ২৪শে এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত আসামি কামালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ বছর কারাদণ্ড প্রদান করেন।

র‌্যাব-৭ মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামিকে গ্রেফতার করার লক্ষ্যে গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।আসামি কামাল হোসেন চাঁদপুর জেলার শাহরাস্থি থানাধীন মেহের স্টেশন রোড এলাকায় অবস্থান করার খবর পেয়ে গত ৩০শে সেপ্টেম্বর পৌনে ৩টার দিকে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে ঘটনার দায় স্বীকার করেছে।

আসামি কামাল জানিয়েছে,কিছুদিন পলাতক থাকার পর একসময় নিজ এলাকা চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ চলে আসে।পরবর্তীতে সে এলাকায় বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।সেখানে ১৯৯৮ হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত স্টুডিওর কর্মচারী হিসেবে ছবি উঠানো,বিয়ে বাড়ির প্যাকেজিং প্রোগ্রাম এর কাজ করতো।২০০১ সাল হতে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সে নিজ ও অন্য এলাকায় গোপনে কৃষিকাজ করেছে।২০০৩ হতে ২০০৭ সাল পর্যন্ত লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ থানায় দায়েরকৃত ডাকাতির মামলায় কারাগারে ছিল।২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়ার পর সে ঢাকার যাত্রাবাড়ির কাঁচামালের আড়তে সবজির ব্যবসা শুরু করে।২০১০-২০১১ সালে সে পুনরায় ডাকাতির প্রস্তুতির দায়েরকৃত মামলায় কারাবাস করে। ২০১১-২০১৩ সালে মুক্তি পেয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছদ্মবেশে কৃষিকাজ করছিল।২০১৩ সালে এলাকা ছেড়ে শাহারাস্থিতে এসে জমি কিনে বালুর ব্যবসা শুরু করে।

আসামির বিরুদ্ধে লক্ষীপুর জেলার রায়গঞ্জ থানায় ১টি এবং চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় ৬টি চুরি, ডাকাতি,নাশকতা এবং মাদক সংক্রান্ত মামলা এবং চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানায় ১টি এসিড নিক্ষেপ সংক্রান্ত মামলা রয়েছে।গ্রেফতারকৃত আসামিকে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন র‌্যাব কর্মকর্তা।

জানা গেছে,হাফেজ মোহাম্মদ জাকারিয়া বর্তমানে সৌদি আরবে কর্মরত রয়েছেন।তিনি বিবাহিত এবং তার ২ সন্তান রয়েছে।এসিডে ঝলসে যাওয়ার পর থেকে এখনও তিনি অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছেন।দীর্ঘ ২৪ বছর পর পলাতক আসামি কামাল হোসেন প্রকাশ বালু কামাল প্রকাশ শান্ত গ্রেফতার হওয়ায় তিনি ও তার পরিবার র‌্যাবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!