শিক্ষার্থীদের কলম উপহার দিতে টাকা জমান প্রতিবন্ধী

0 ৩৮৭,৬২৪

হাসপাতালের সফেদ-পরিচ্ছন্ন আঙিনায় বসে আছেন এক প্রতিবন্ধি-কুষ্ঠরোগী।হাত-পায়ের আঙ্গুলগুলো ক্ষয়ে গেছে কুষ্ঠরোগের দহনে। হাঁটাচলা করতে পারেন না।একপাশে হুইল চেয়ার আর সামনে খোলা পত্রিকার পাতা।তারই মাঝে আছে ডজনখানেক কলমের একটি প্যাকেট।আশপাশে ছোট ছোট স্কুল শিক্ষার্থীদের কোলাহল,প্রাণোচ্ছল ছোটাছুটি।মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে স্কুল শিক্ষার্থীদের সাথে খুনসুটি আর হাসিখুশিতে মেতে উঠছেন।দূর থেকে খুনসুটি-দুষ্টুমি মনে হলেও কাছে গিয়ে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের মাঝে কলম উপহার দিচ্ছেন।সালাম-হ্যান্ডশ্যাক সেরে একে অপরের সাথে বন্ধুত্বসূলভ খোশগল্প জড়িয়ে পড়ছেন।বৃহস্পতিবার(২১ জুলাই)রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা-কদমতলী ইউনিয়নের লিচুবাগান খ্রীষ্টিয়ান কুষ্ঠ চিকিৎসা কেন্দ্রের আঙিনায় এমন চিত্র দেখা যায়।

আনোয়ারুল হক পারেভেজ(৩১)।চকরিয়া মানিকপুর এলাকার মো. ইসমাইল ও মাহমুদা দম্পতির মেঝ ছেলে। জন্ম থেকে শারিরীক প্রতিবন্ধী,তারওপর ২০০৮ সাল থেকে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত।৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর আর পড়া হয়নি।শারিরীক প্রতিবন্ধিতা ও কুষ্ঠরোগের কারণে পরিবার-সমাজ থেকে সহযোগিতার বদলে পেয়েছেন বঞ্চনা।তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য,অভিশপ্ত ও ‘পাপের ফল’ তকমাসহ লোকমুখে নানা কথা শুনতে শুনতে বিষিয়ে উঠে পারভেজের মন-প্রাণ।ক্ষোভ-অভিমানকে সঙ্গী করে বাড়ি ছেড়ে বের হন অজানা পথে।আজ ১৪ বছর ধরে সেই পারভেজের ঠাঁই চন্দ্রঘোনা খ্রীষ্টিয়ান কুষ্ঠ কেন্দ্রে।

পড়াশোনার প্রতি ছিল তার তীব্র আকর্ষণ।স্বপ্ন ছিল বড় মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে প্রতিবন্ধিতাকে জয় করবেন।কিন্তু শারিরীক অক্ষমতাসহ নানা অসুবিধার কারণে প্রাথমিকের গণ্ডি পার পতে পারেননি।পড়াশোনা নিয়ে নিজের স্বপ্ন মাটি হলেও সেই স্বপ্ন অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান পারভেজ।ভিক্ষাবৃত্তি করতে চান না,তবে কেউ খুশি মনে কয়েক টাকা দিলে তা জমিয়ে রাখেন তিনি।তিল তিল করে দীর্ঘদিনে জমানো সেই টাকা দিয়ে ডজন ডজন কলম কিনেন পারভেজ।এসব কলমই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিলিয়ে দেন।এভাবে ২০২১ সাল থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ কলম বিলিয়ে দিয়েছেন পারভেজ।

বৃহস্পতিবার কলম উপহার পাওয়া কাপ্তাই নৌবাহিনী স্কুল এন্ড কলেজের ৯ম শ্রেণির ছাত্র অর্ণব বড়ুয়া বলেন,পারভেজ ভাই আমাদের অনেক স্নেহ করেন।স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় প্রতিদিন ভাইয়ের সাথে আমাদের দেখা হয়, কথা হয়।আজকে আমাকে একটি কলম উপহার দিয়েছেন।এভাবে অনেককে দিতে দেখেছি।আমাদেরকে মা-বাবার কথা মেনে চলতে,ভালো করে পড়াশোনা করতে,সব সময় সুপরামর্শ দেন।

কাপ্তাই নৌবাহিনী স্কুল এন্ড কলেজের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহ ইসলাম রিমন বলেন,আমাকে খুশি হয়ে তিনি কলমটা দিয়েছেন। আমার এখানে এলে ওনি আমাদের হাতের ইশারায় ডাকেন।ক্লাস-পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানতে চান।কলমটা পেয়ে আমার খুব ভালো লেগেছে।আমাদের দেখতে পারেন বলে কলমটা দিয়েছেন।

কেন শিক্ষার্থীদের কলম দেন,জানতে চাইলে প্রতিবন্ধী আনোয়ারুল হক পারভেজ একুশে পত্রিকাকে বলেন,আমার জীবনে পড়ালেখা করার খুব ইচ্ছা ছিল।কিন্তু করতে পারিনি।আমি চাই,পড়ালেখার প্রতি আমার যে দরদ তা যেন শিক্ষার্থীরা উপলব্ধি করে নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়।আর সবচেয়ে বড় কথা হলো,প্রতিবন্ধি জীবনে অনেক চাপা কষ্ট থাকে।দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে পরিবারের সাথে দেখা নেই।এসব কষ্ট ভুলে থাকতে শিক্ষার্থীরা আমাকে সহযোগিতা করে।তাদের সাথে কথা বললে আমার কষ্টগুলো উবে যায়। মনটা অনেক ভালো হয়ে যায়।আমার যদি আরও বেশি টাকা-পয়সা থাকতো তাহলে গরিব-মেধাবী শিক্ষার্থীদের পুরো পড়াশোনার দায়িত্ব নিতাম।অন্তত ১ টাকা দিয়ে হলেও গরিব-দুঃখী মানুষের মেয়ের বিয়েতে শরীক হতাম।কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও আমার সেই তাওফিক নেই।

পারভেজ বলেন,কলম দিয়ে মানুষ পড়ালেখা করবে, তাতে তাদের জ্ঞান বাড়বে।শিক্ষার্থীরা কলম নিয়ে পরীক্ষায় পাশ করলে তাদের মা-বাবা খুশি হবে,তাই দিই।এর প্রতিদান হাশর কিয়ামতে আল্লাহতায়ালা আমাকে দেবেন।আমি পড়ালেখা করতে পারিনি।তাই ছেলেমেয়েদের কলম দিচ্ছি।তারা যেন পরীক্ষায় পাশ করতে পারে।এছাড়া আরেকটি কারণ আছে তা হলো,আমার বাবা বলেছিলেন, আমার নিয়ত ঠিক নেই,মাজারে থাকলে মানুষ থেকে খাইতে পারে,খাওয়াতে পারে না-এই কথার কারণে।কী জন্য নিয়ত ঠিক থাকবে না,কেন খাওয়াইতে পারবো না-সেজন্য এটা শুরু করেছি।শুকরিয়া-আলহামদুলিল্লাহ,আমি এখন খুশি আছি।এখন থেকে মাদরাসার কোরআনে হাফেজ,মসজিদের খতিব-মোয়াজ্জিনকে দেব।

এ কথাগুলো বলার সময় কথা বলার ফাঁকে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে পারভেজের।হঠাৎ ভারী হয়ে উঠে হাসপাতালের আঙিনা। হতবাক হয়ে পড়ে পাশে থাকা কাপ্তাই নৌ-বাহিনী স্কুলের শিক্ষার্থীরাও।আক্ষেপ করে পারভেজ বলেন,আহা,মা-বাবা যদি আমাকে একবার দেখতে আসতো,তাহলে আমার মনে আর কোনো কষ্ট থাকতো না।আমার মা-বাবা কেন আমাকে নিতে,দেখতে আসে না। আমার খুব ইচ্ছা করে তাদের দেখতে।আমি না হয় ক্ষোভ আর অভিমানে বাড়ি ছেড়েছিলাম,তাই বলে তারা এভাবে চুপ করে থাকবে। আমি তাদের এক পলক দেখতে পেলে খুব বেশি খুশি হতাম।

আমার জীবনে একটাই স্বপ্ন তা হলো,আমি মারা যাওয়ার পর চট্টগ্রামের ষোলশহরস্থ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার মাঠে যেন আমার জানাজা হয়।এই মাদ্রাসাকে আমি খুবই ভালোবাসি।আমার অন্তর পড়ে থাকে জামেয়ার ময়দানে।জানাজাটা সেখানে হলে মরেও শান্তি পাবো বলে মনে হচ্ছে।বলেন পারভেজ।

কুষ্ঠ চিকিৎসা কেন্দ্র সম্পর্কে পারভেজ বলেন,এ হাসপাতাল আমাদের মা-বাবার মতো।আন্তরিকতার সাথে আমাদের সেবা দিচ্ছে। সমাজের মানুষ আমাদের অভিশপ্ত মনে করতো,আমাদের সংস্পর্শে আসতো না,সে জায়গায় এই হাসপাতাল না থাকলে আমাদের মরে যেতে হতো।এই হাসপাতাল যেন কোন দিন বন্ধ না হয়,সেজন্য সরকারসহ সমাজের বিত্তবানদের সুনজর দিতে হবে।

প্রসঙ্গত,৬০ শয্যার এ কুষ্ঠ চিকিৎসা কেন্দ্রটি তৈরি হয় ১৯১৩ সালে।এটি ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন কুষ্ঠ হাসপাতাল।বর্তমানে এটি বৃহত্তর চট্টগ্রামের জটিল ও প্রতিবন্ধী কুষ্ঠরোগীদের একমাত্র রেফারেল হাসপাতাল।রোগনির্ণয়,চিকিৎসা, খাবার ও প্রতিবন্ধী রোগীদের নানা উপকরণ এখানে বিনামূল্যে দেওয়া হয়।

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!