সুলেখা আক্তার শান্তার গল্প ” ফিরে এসো “।

0 ৫০৬,৬৭৮
ফিরে এসো

সুলেখা আক্তার শান্তা

রবিন এখন এক ভিন্ন নগরের বাসিন্দা।এ শহরের প্রাণকেন্দ্রে এক মেসে এসে উঠেছে সে। এই মেসে রবিন একা একা শুয়ে ভাবছে রেমার কথা রেমার জন্য আমার মনের মধ্যে এমন করছে কেন?যেখান থেকে এত দূরে চলে এলাম এখানেও স্বস্তি পাচ্ছি না।জানি না,তুমি কেমন আছো?তোমাকে ভুলতে পারব না আর ভুলতেও চাই না।শুধু ওখান থেকে চলে এলাম, কারণ যে পথে তুমি আমি একসাথে চলতাম সে পথে আমি তোমাকে ছাড়া একা চলবো কী করে?তোমার প্রতি শুভকামনা আমার,তুমি সুখী হও।তুমি সুখে থাকো এ কামনা আমার।
কয়েকদিন মেসে থাকার পর রবিনের মনে হয় এভাবে শুয়ে বসে কতদিন?একটা কাজ দরকার।বাঁচার তাগিদে আমাকে কাজ খুঁজতে হবে,ভাগ্যের দারপ্রান্তে আমাকে সব সময় দাঁড়াতে হয়।হায়রে কপাল,তুই এই নিয়ে জন্মেছিলি!সবকিছু হারানোই ছিল আমার কপালে!

অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটি কাজ পায় রবিন।সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত থাকে কাজে। কাজশেষে সোজা মেসে।মেসে তার কাজ একটাই রেমাকে নিয়ে ভাবনার জগতে ডুবে থাকা।

এদিকে দিন,সপ্তাহ,মাস চলে যাচ্ছে।রেমার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না।ডাক্তারের চিকিৎসা চলছে।কিন্তু কোন পরিবর্তন নেই।অহনা স্বামীকে দোষে।তুমি বাবা হয়ে মেয়ের জীবনটা এমন করে দিতে পারলে?তুমি বলো মেয়ের এমন জীবনের জন্যে আমিই দায়ী?

এখন যত কাঁদো কোন লাভ হবে না।সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়,তা নাহলে এর মাশুল দিতে হয়।তুমি পারবে আমার মেয়েকে ভালো করতে,কারণ তোমার টাকা আছে না?এবার টাকা দিয়ে মেয়েকে ভালো করো।আজ কোন কথা নেই আনানের মুখে।চোখে শুধুই জল।
অনা বান্ধবীর প্রতি ভালোবাসার টানে রবিনকে কত না জায়গায় খোঁজে।কিন্তু রবিনের কোন সন্ধান পায় না।প্রতিদিন রেমার কাছে যাওয়া, ওর দিকে লক্ষ্য রাখা তার নিত্যদিনের রুটিন। এদিকে অহনাও মেয়ের জন্য অসুস্থ হয়ে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে বিছানায় পড়েছে।তাকে বাসায় ডাক্তারের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।অহনা বলে,আমার শরীরে কোন অসুখ নেই,আমার সব অসুখ মনে।আমি আমার মেয়ের কাছে যাবো।

আনান বলে,আগে নিজে সুস্থ হও তারপরে রেমার কাছে যেয়ো।রেমার কাছে আমার যাওয়া হয়,অনা যায়,রেমার শ্বশুরবাড়ির মানুষ তো আছেই।

এসবের জন্য তুমি একা দায়ী।কেন তুমি একা সামলাতে পারছো না?তোমার অনেক কিছু সামলানোর ধারণক্ষমতা তো আছে।তুমি সুস্থ হও তারপর যত পারো আমাকে বলো?

রেমার পাগলামি দিন দিন বাড়ছে ছাড়া কমছে না। ডাক্তারের চিকিৎসা চলছে।কিন্তু নেই তার কোন প্রতিকার,নেই রেমার কোন বোধশক্তি। খাওয়া দাওয়া কোন কিছুই করছে না। অপরিচিতদের সাথে যে আচরণ করে আপনের সাথেও একই আচরণ করে,তার কোন পরিবর্তন নেই।কখনো অঝোরে ঝরতে থাকে চোখের অশ্রম্ন,কখনো কাউকে কোন কিছু ছুড়ে মারে।শ্বশুরবাড়িতে রেমাকে নিয়ে আলাপ হয়। ছায়মা বেগম ছেলের আগামী জীবন নিয়ে শংকিত।ছায়মা বলল সাব্বিরকে,কেন এমন করতে গেলে?আমি আবার কী করলাম?
এখানে ছেলেকে না বিয়ে করালেও পারতে। একবার যখন দেখলে বিয়েতে মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, রেমার কোন সেন্স ছিল না,সেই মেয়ের সাথে আমাদের ছেলের বিয়ে পড়ানোর কী দরকার ছিল?
আমার চেয়ে তো তুমি রেমাকে বেশি পছন্দ করেছো।আর বললে,ছেলেকে বিয়ে যদি করাতে হয় তাহলে এখানেই বিয়ে করাবে?
হ্যাঁ বলেছি? কিন্তু বিয়ে পড়াতে গিয়ে যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেল মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল,এরপর তোমার ওখানে বিয়ে করানো উচিৎ হয়নি।
এ কাজটা করা আমাদের ঠিক হতো,আজ যদি তোমার ছেলের এমন হতো? তখন তুমি কী করতে? আমরা যদি বিয়ে বন্ধ করে দিতাম সেটা কোন ভালো মানসিক পরিচয় হতো?
থাকো তুমি তোমার ভালো মানসিকতা নিয়ে। তার চেয়ে আমরা কাজ করি, ছেলেকে অন্য কোথাও বিয়ে করিয়ে দেই?
এখনই এটা করা আমাদের ঠিক হবে না।
কেন ঠিক হবে না? রেমা যদি সুস্থ হয়ও থাকবে আমাদের কাছে। ওকে তো আমরা ফেলবো না।
সবকিছু হুট করে হয় না। দেখা যাক কী হয়।
ডাক্তার রেমার কোন পরিবর্তন দেখছে না। আর হবে কি না তাও বলতে পারছে না।

 

রবিন চাকরি করে কিছু টাকা জমিয়েছে। তার ইচ্ছা এ টাকা দিয়ে সে ছোট একটা ব্যবসা শুরু করবে। সে একটা কাপড়ের দোকান দেয়। ব্যবসা মোটামুটি ভালো চলতে থাকে। সব সময় তার মনের মধ্যে রেমার জন্য ভাবনা হয়। তোমার জন্যে স্থান পরিবর্তন করলেও মনের ভাবনায় পরিবর্তন আসেনি। পারছি না তোমায় ভুলে থাকতে, তুমি আমার মনের মণিকোঠায় আছো, থাকবে সেখানে চিরদিনের জন্যে। কেউ তোমাকে সরাতে পারবে না সেখান থেকে। জানি না তুমি কেমন আছো, আমি চাই তুমি সব সময় ভালো থাকো। তাই তো তোমার সুখের জন্য আমি অনেক দূরে চলে এলাম। আমার ছায়া যেন তোমাকে গ্রাস করতে না পারে। ভুলে যাবে একদিন ঠিকই আমাকে, কিন্তু আমি পারব না ভুলতে তোমাকে।
আস্তে আস্তে রবিনের ব্যবসা বড় হতে থাকে।

 

আনান মেয়ের কাছে গিয়ে মাথার উপর হাত রাখল। বাবার প্রতি রেমার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। মারে আমি তোকে বুঝতে পারিনি। আজ যখন বুঝতে পারলাম তখন কিছু করার নেই আমার। তোর সুস্থ হওয়াই যে আমার কাম্য, তোর জন্য তোর মা—ও বিছানায় পড়ে আছে।
অনা আনানকে শান্ত¦না দিয়ে বলে, আঙ্কেল একজন পাগলের সাথে এসব কথা বলে কী লাভ? একটু ঠেস দিয়ে বলে, ও তো কোনকিছু করতে পারবে না আপনার জন্যে।
মারে আমার মেয়েকে পাগল বলো না। আমার মনের মাঝে দারুন আঘাত লাগে।
আঙ্কেল ভেবে দেখেন, ও পাগল হলো কার জন্যে? যে ভুল আপনি করেছেন সে ভুলের জন্যে কতভাবে কতজনের জীবন নষ্ট হচ্ছে।
যে বুঝ আমার মধ্যে এখন কাজ করছে এ বুঝ আগে আমার মধ্যে কাজ করলে আজ এমন হতো না।
মানুষ ভুল করার সময় বুঝতে পারে না, তাহলে সে ভুল করে না। ভুল করার সময় ভুলকেই সঠিক মনে হয়। এতদিন পরেও যখন বুঝতে পেরেছেন ভুলটা তাও ভালো। এখন শুধু ওর জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।
তাই তো করি মা, আল্লাহ যেন ওকে ভালো করে দেন। আমি এখন যাই মা, ওদিকে তোমার আন্টি বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। খাওয়া দাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে।
রেমা হাসপাতালে শুয়ে ‘রবিন রবিন’ আওড়াচ্ছে। এমন সময় অর্পণ এসে হাজির। অর্পণ জিজ্ঞেস করল, কে এই রবিন?
অনা সামাল দেবার চেষ্টা করে— আরে পাগল মানুষ, কখন কী বলে তার কোন ঠিক আছে? বাদ দিন ওর কথা।
অনা চেপে গেল রবিনের কথা। মনে হয় সে কিছুই জানে না, যেন তার কাছে অচেনা অজানা নাম রবিন। অনা বলল অর্পণকে, বিয়ে করেও হলো না আপনাদের সংসার!
এসব লেখা ছিল আমার আর আমার স্ত্রীর কপালে। তাহলে কী করেই বা হবে আমাদের সংসার। ও ভালো হোক এটাই শুধু কামনা করি আমি।
যাক, রেমার ভাগ্য ভালো সে আপনার মতো একজন স্বামী পেয়েছে।
ভালো স্বামী হব তখন যখন ওকে পরিপূর্ণ সুখী করতে পারব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওর জন্যে যদি অপেক্ষা করে থাকতে পারি, তাহলে হয়তো একথা শুনলে ভালো লাগবে।
হয়েছে হয়েছে, পেরে উঠছি না আপনার সাথে।
অর্পণ রেমার পাশে বসে। রেমা কেউ আসলেই তার নাক ধরবে, চুল টানবে, কিন্তু কথা বলবে না। আর খেতে চায় না, শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অর্পণকে খামচিও মারে রেমা। অর্পণ তখন বিরক্ত না হয়ে হাসতে থাকে। শুধু একটাই ভয়, মা যেন খামচির দাগ না দেখে।

 

শ্বশুরবাড়িতে আবার বৈঠক।
ছায়মা সাব্বিরকে বলে, তুমি কী সিদ্ধান্ত নিলে?
সাব্বির বলে, কীসের সিদ্ধান্ত?
আমি যে বললাম ছেলেকে বিয়ে করাবো? এ বউকে নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলে, আমার এসব শুনতে ভালো লাগে না।
আচ্ছা দেখো, একটা পরিবারের উপর ঝড় বয়ে চলেছে, এ অবস্থায় আমরা এরকম সিদ্ধান্ত নেই কী করে বলো?
অন্যের কথা ভাবলেই হবে? আগে নিজের কথা ভাবো।
হ্যাঁ ভাববো।
পাড়া প্রতিবেশীরা কত কথাই না বলছে? মান—সম্মান সব গেল!
এত কথায় কান না দিলে হয় না? তারা বলছে বলুক, না শুনলেই হয়।
আমি কান বন্ধ করেই আছি, তারপরও মানুষের মুখ তো আটকানো যায় না। এ সময় অর্পণ হাসপাতাল থেকে ফিরে আসে। মা তাকে ডেকে কাছে বসায়। অর্পণকে বলে, বাবা অর্পণ, আমরা তোকে আবার বিয়ে করাব।
মা এসব তুমি কী বলছো? বলে দাঁড়িয়ে গেল অর্পণ।
বাবা এভাবে কি জীবন চলে? বউমার তো কোন পরিবর্তন হচ্ছে না!
মা, আজ হচ্ছে না তো কাল হবে। দেখবে, ও ঠিকই ভালো হয়ে যাবে।
এভাবে তুই অপেক্ষা করতে থাকবি? দেখ বউমাকে আমরা কত পছন্দ করে আনলাম।
মা, আমাকে বিয়ের কথা বলো না। এ আমার দ্বারা হবে না।
তোমাদের বাবা ছেলেকে আমার বুঝানো সম্ভব নয়। অপেক্ষায় থাকো এভাবে যতদিন ইচ্ছা।
অর্পণ রাগ হয়ে মন খারাপ করে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে থাকে।
রেমা কথাই বলে না। হঠাৎ কখনো ‘রবিন’ বলে উঠে। তাই শুনে অনা রেমাকে বলে, তুই কি আর কোন কথাই জানিস না? আমি যে তোর জন্য এত খেটে যাচ্ছি একবারও তো আমার নাম বলিস না। তোর জন্য কতগুলো মানুষ হয়রান হচ্ছে! রেমা শুধু হি হি করে হেসেই যাচ্ছে।
পাগলের থাকে কোন নীতি—নিয়ম? একাধারে সে হেসেই যাচ্ছে। কোথায় পাবো তোর রবিনকে? জানলে আমি সেখান থেকে তোর জন্যে খুঁজে আনতাম। আজ তুই জানিস না তার কথা, সে জানে না তোর কথা। দুজন অজানা দুই প্রান্তে।

 

অনেকদিন গড়িয়ে যায়। মাস, বছর পেরিয়ে যায়। রেমার উন্নতি নেই। রেমা এখন বাসায়। অনা খোঁজ খবর নেয়। আনান রেমার জন্যে নার্স রেখেছে। অহনা একমাত্র পাগল মেয়েকে নিয়ে বেঁচে আছে। এভাবে কাটল আরও একটি বছর। আনান জানে না তার জেদের ফল কতদূর গিয়ে পৌঁছবে।

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!