সন্দ্বীপে “প্রাইম ” এর আলোয় আলোকিত হচ্ছে নারী ও কিশোর-কিশোরীরা

0 ৩৭১
সন্দ্বীপ প্রতিনিধিঃ বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস),চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায় পিছিয়ে পড়া নারী ও কন্যা শিশুদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে ও তাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ১৯৮৬ সাল থেকে নানামুখী প্রকল্প হাতে নিয়ে কাজ করে আসছে।আর এই বেসরকারী উন্নয়ন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন- দেশের নারী উন্নয়নের অগ্রদূত ও বিশিষ্ট নারী নেত্রী, বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবীর।বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ,সন্দ্বীপ কেন্দ্রের বর্তমানে একটি চলমান প্রকল্পের নাম-” প্রমোটিং রাইটস্ থ্রো মবিলাইজেশন এন্ড এমপাওয়ারম্যান্ট সংক্ষেপে ” প্রাইম “।যা ২০১৮ সালের জুলাইতে কাজ শুরু করে।প্রাইম প্রকল্পের স্বপ্ন- সকল প্রকার বৈষম্য মুক্ত একটি সমাজ।আর অভীষ্ট হচ্ছে-ক্ষমতায়ন ও সামাজিক রূপান্তরের মাধ্যমে নারী- পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা। প্রকল্পের লক্ষ্য – এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে যেখানে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া নারীরা তাদের অধিকার রক্ষায় সামাজিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারবে। যার উদ্দেশ্য হবে -(১) প্রকল্প এলাকার বঞ্চিত নারীরা সামাজিক,অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করবে। এর সূচক হবে -(ক) সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা আদায়ের মাধমে ৩০% সেবা বৃদ্ধি পাবে।(খ) আয় বৃদ্ধি মুলক কাজে জড়িত হয়ে সদস্যদের ২০% আয় বৃদ্ধি পাবে।(২) প্রকল্প এলাকার নারী ও কন্যা শিশুরা,নারী ও কিশোরীদের উপর সহিংসতার বিরুদ্ধে সুরক্ষিত হবে। এর সূচক হবে -(ক) কর্ম এলাকায় ১০০ জন চেঞ্জমেকার তৈরী হবে।(খ) প্রতিটি স্কুলে যৌন হয়রানী প্রতিরোধ কমিটি সক্রিয় হবে।
সন্দ্বীপে নারী প্রগতি ‘ র প্রাইম প্রকল্পের কর্ম এলাকা- সারিকাইত,মাইটভাঙ্গা,মগধরা,মুছাপুর,রহমতপুর,হারামিয়া,বাউরিয়া ও পৌরসভা আংশিক।এ এলাকা গুলোর মধ্যে অবস্থিত কাজী আফাজউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়,সাউথ সন্দ্বীপ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়,
আবেদা ফয়েজ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়,মাইটভাঙ্গা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়,বদিউজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয়,জেবেন্নুর সুলতান উচ্চ বিদ্যালয়,রহমতপুর উচ্চ বিদ্যালয়, এনাম নাহার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়,দ্বীপবন্ধু মুস্তাফিজুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয় ও বাউরিয়া জি,কে একাডেমী,এই ১০ টি বিদ্যালয়ে নারী প্রগতির প্রাইম প্রকল্প গঠন করেছে -১০ জনের একটি করে ‘ ইয়ুথ গ্রুপ ‘।
যার ৫ জন ছেলে, ৫ জন মেয়ে সদস্য। পড়ালেখার পাশাপাশি যাদের কাজ হচ্ছে – স্কুলের মেয়েদের ১৮ ও ২১ এর আগে বিয়ে নয় এই শ্লোগান কে সামনে রেখে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন করা ও প্রতিরোধে সাধ্য মতো ভূমিকা রাখা। ইভটিজিং থেকে রক্ষা পেতে শিক্ষক,অভিভাবক,স্থানীয় জনপ্রতিনিধি প্রয়োজনে আইনী সহায়তার শরণাপন্ন হওয়া। এলাকায় নারীর প্রতি সহিংসতা হলে, তা বন্ধে রাস্ট্রীয় জরুরী সেবার সাহায্য নেয়া।
এ ব্যপারে রহমতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইয়ুথ গ্রুপ সদস্য ফারিয়া ইয়াছমিন ইমু,মেহেরুন্নেছা সাদিয়া,সাবরিনা পারভীন তাসপিয়া, ফাহমিদা আলম পুস্প,বেলাল খান,জেবেন্নুর সুলতান উচ্চ বিদ্যালয়ের ইয়ুথ গ্রুপ সদস্য আশিকুল ইসলাম, শিমুল রায় ও দ্বীপবন্ধু মুস্তাফিজুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের ইয়ুথ গ্রুপ সদস্য নাজমুল আলম,কাজী আফাজউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ইয়ুথ গ্রুপের সদস্য কাজী ফাতিহা,কাজী নিজামউদ্দিন,হীরা বেগম এর সাথে কথা হয়। তারা এ প্রতিবেদক কে জানায়- গত বছর সন্দ্বীপের জেবেন্নুর সুলতান উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী ‘ র উপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদের ইয়ুথ গ্রুপের সদস্যরা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে,স্কুলের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকদের নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন,যার ফলে প্রশাসনের টনক নড়ে এবং যৌন নির্যাতনকারী কে আটক করে এবং তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যাবস্থা নেয়। একই বছর রহমতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে অভিভাবকরা জোর পূর্বক বিয়ের আয়োজন করলে সন্দ্বীপ পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় সে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়া হয়।
রহমতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সমুখ থেকে কিছু ইভটিজার কে পুলিশী সহায়তায় ধরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিলে চেয়ারম্যান তাদের ভবিষতের জন্য শাসিয়ে তাদের অভিভাবকদের ডেকে মুচলেকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন।কাজী আফাজউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ইয়ুথ গ্রুপের সদস্যরা বলেন- বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীকে স্কুলে আসা- যাওয়ার পথে একটি ছেলে ইভটিজিং করতো তাকে ইয়ুথ গ্রুপের সদস্যদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে এলাকাবাসীর সহায়তায় শিক্ষকরা স্কুলে ধরে আনে, আবং পুলিশের হাতে তুলে দিবে বলে ভয় দেখায়। পড়ে ভবিষ্যতে সে আর এ কাজ করবে না বলে তার কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। দ্বীপবন্ধু এম,আর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইয়ুথ গ্রুপের সদস্যরা দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রীর বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দিয়েছে। তারা ঐ ছাত্রীর রেজিস্ট্রশন কার্ড নিয়ে অভিভাবকদের দেখিয়ে জানায় বিয়ে বন্ধ না করলে তারা আইন ও প্রশাসনের সহযোগিতা নেবেন।পরে অভিভাবকরা বিষয়টি বুঝতে পেরে মেয়েকে বিয়ে দেয়া থেকে সরে আসেন।বর্তমানে ঐ মেয়েটি মুস্তাফিজুর রহমান ডিগ্রী কলেজে ১ম বর্ষে পড়ছে।
ইয়ুথ গ্রুপের এ সকল তৎপরতায় একদিকে যেমন বাল্যবিবাহের প্রবনতা হ্রাস পাচ্ছে,অন্যদিকে যৌন নির্যাতন ও ইভটিজিং কারীরাও দমিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া যে কোনো প্রয়োজনে মানুষ সরকারী জরুরী সেবা সমুহের সাহায্যও নিচ্ছে,যা জনগনের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার একটি ইতিবাচক দিক বলে ইয়ুথ গ্রুপের সদস্যরা মনে করে।নারী প্রগতির প্রাইম প্রজেক্টের ইয়ুথ গ্রুপের মতো প্রকল্প এলাকায় ২০ জনের এক একটি মহিলা সমিতি রয়েছে। মুছাপুর ৩ নং ওয়ার্ডের আহসান মিজির বাড়িতে এ রকম একটি সমিতির নাম ‘ দোয়েল নারী উন্নয়ন সমিতি ‘ এর সভাপতি আকতারা বেগম,সেক্রেটারী রোকসানা বেগম এবং ক্যাশিয়ার বিধবা সবুজা বেগম। সরেজমিনে পরিদর্শনে গেলে তারা এ প্রতিবেদককে জানায় – তারা নিভৃত পল্লীর দরিদ্র নারী।
নারী প্রগতি সংঘের প্রাইম প্রকল্পের সাথে থেকে তারা নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করে সরকার প্রদত্ত বয়স্ক ভাতা,বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা সমিতির সদস্যদের মধ্যে যারা পাওয়ার যোগ্য তাদের জন্য আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। এতে করে তাদের ইউনিয়ন পরিষদের সাথে যোগাযোগ বেড়েছে। এ ছাড়া তারা ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে গবাদি পশু পালন,হাঁস-মুরগী পালন, বাঁশ-বেতের কাজ, হস্ত শিল্প সহ নানা আয় বর্ধক কাজের মাধ্যমে নিজেদের আর্থ -সামাজিক অবস্থার উন্নতিতে সচেষ্ট হচ্ছেন।এসডিজির শ্লোগান ” কেউ পিছিয়ে থাকবে না “, এ লক্ষে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে বদ্ধপরিকর তারা। বর্তমানে দোয়েল নারী উন্নয়ন সমিতির সদস্যদের দলীয় সঞ্চয় ২ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে বলে তারা জানান।এ ছাড়া তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সচেতনতাও আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা এখন করোনাকালীন সময়ে কী ভাবে হাত ধুতে হবে,বাহিরে গেলে মাস্ক পড়তে হবে। শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখতে হবে, বর্তমানে করোনা টিকা নেয়ার জন্য নারী প্রগতির প্রাইম প্রকল্পের কর্মীদের সহায়তায় অনলাইনে নিবন্ধন করতেও উৎসাহিত হচ্ছেন, মেয়েদের বাল্যবিবাহ না দিয়ে পড়ালেখায় উৎসাহিত করছেন।
এলাকার উঠতি যুবতী ও মধ্য বয়সী মহিলাদের জন্য নারী প্রগতি সংঘের এই প্রাইম প্রকল্প গত ২০১৯ সাল থেকে সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা করে আসছে। সেলাই প্রশিক্ষণের সকল উপকরনের মাধ্যমে এ সংগঠনের শিবেরহাট কেন্দ্রে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রথম ব্যাচে ২৫ জন নারী কে দক্ষ কাটিং মাস্টার দ্বারা সেলাই প্রশক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের সনদ প্রদান ছাড়াও এককালীন নগদ ৩০০০ টাকা প্রদান করে। এ টাকার সাথে আরো কিছু টাকা যোগ করে সারিকাইত ৩ নং ওয়ার্ডের আবাসন কলোনীর ২ মেয়ে ১ ছেলের জননী নারী প্রগতির প্রাইম প্রকল্পের সেলাই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নাজমা বেগম(৩৭) বর্তমানে সেলাই কাজ করে মাসে ৮/৯ হাজার টাকা রোজগার করছেন।
পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি করতে ও পরিবারের আয়-রুজি বাড়াতে বেকার স্বামীকে দিয়ে গত ১ বৎসরের মধ্যে একটি ছোটো-খাটো চায়ের দোকান পরিচারনা করছেন। বর্তমানে নাজমার পরিবারের আর্থিক অনিশ্চয়তা দুর হয়ে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠায় তারা খুশি।
নারী প্রগতির প্রাইম প্রকল্পের আরেকটি সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে বিএনপিএস এনার নাহার কেন্দ্র অফিসে। এখান থেকে ২০২০ সালের মার্চে ৩০ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুছাপুর ৭ নং ওয়ার্ডের ধনকাজীর বাড়ীর আপেল নারী উন্নয়ন সমিতির সভাপতি স্বামী পরিত্যাক্তা খালেদা বেগম(৩৫)ঘরে বসে সেলাই কাজ করে বর্তমানে মাসে সাড়ে ৭ হাজার টাকার মতো আয় করছেন। এতে করে তার দারিদ্রতা দুর হয়েছে। আশ্রয়হীন এ নারী গত ১ বছরে সামান্য জমি ক্রয় করে থাকার জন্য একটি কাঁচা ঘরও দিয়েছেন। স্থানীয় বদিউজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রণিতে পড়ুয়া তার একমাত্র কন্যাকে নিয়ে খালেদা বেগম আর্থিক স্বচ্ছলতায় দিন কাটাচ্ছেন।
তিনি তার মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখছেন।
সন্দ্বীপে এ রকম অনেক উদাহরন সৃস্টি করেছে নারী প্রগতি সংঘের ‘ প্রাইম ‘প্রকল্প। এ বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার সন্দ্বীপ কেন্দ্র ব্যাবস্থাপক মোঃ সামসুদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন- জার্মানী ‘ র দাতা সংস্থা – গ্রেড ফর দ্যা ওয়ার্ল্ড এর অর্থায়নে
এবং বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের ব্যাবস্থাপনায়, সন্দ্বীপ কেন্দ্র প্রাইম প্রকল্পের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!