‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এবং বাংলাদেশের ভিনদেশী বন্ধুরা।

0 ১৭৮

আফ্রিকার ক্ষুদার্তদের জন্য,ল্যাটিন আমেরিকার রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা কিংবা এশিয়ার নিপীড়িত জাতির মুক্তিতে সহায়তার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলো চ্যারিটি কনসার্ট আয়োজিত হয়েছিলো, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পন্ডিত রবি শংকর তখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন।একাত্তরের গনহত্যার খবর শুনে,তিনি স্বজাতির জন্য কিছু একটা করার উপলব্ধি করেন।১৯৭১ সালের এপ্রিল-জুন মাসে রবি শংকর ও জর্জ হ্যারিসন একত্রে ‘রাগা’ অ্যালবামের জন্য লস অ্যাঞ্জেলসে কাজ করছিলেন।

উল্লেখ্য,ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে রবিশঙ্করের কাছে সেতারবাদন শিখতে শুরু করেন হ্যারিসন। একইসঙ্গে যোগসাধনাও করেছেন।হ্যারিসন কয়েকবার ভারতে এসেছিলেন।পরবর্তীতে তিনি ভারতীয় সাংস্কৃতিক দর্শনে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।এভাবেই তাঁদের মধ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে,যা জীবনের শেষ পর্যন্ত ছিলো।

হ্যারিসনকে আমেরিকাতে একটি চ্যারিটি কনসার্ট আয়োজনের কথা বলেন রবি শংকর।জুন মাসের শেষের দিকে এ্যান্থোনি ম্যাসকারনহাস এর বাংলাদেশ সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় সানডে টাইমস পত্রিকায়।হ্যারিসনকে এ ব্যাপারে প্রভাবিত করতে,তিনি বিভিন্ন তথ্য ও সংবাদ উপস্থাপন করেন।

হ্যারিসন গভীরভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং কনসার্টের জন্য উঠে পড়ে লাগেন।প্রাথমিকভাবে তাদের টার্গেট ছিলো অন্তত ২৫ হাজার ডলার অর্থ সংগ্রহ করা।

হ্যারিসন সর্বপ্রথমে তার প্রাক্তন ব্যান্ড দল বিটলস এর সদস্যদের আহবান জানান।এতে পল ম্যাকার্টনি সরাসরি অস্বীকৃতি জানান,কারণ তখন মূলত ব্যান্ডের সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিলো না। প্রাথমিকভাবে জন লেনন অনুষ্ঠানে আসার আশ্বাস দেন।কিন্তু সে সময় আদালতে সন্তানের ব্যপারে, লেননের সাথে স্ত্রী ইয়োকো ওনোর আইনি লড়াই চলছিলো।কনসার্ট এর এক সপ্তাহ আগে,তিনিও অপারগতা জানিয়ে দেন।আর মিক জ্যাগার তখন ছিলেন ফ্রান্সে। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তার পক্ষেও আসা সম্ভব হয় নি।শেষ পর্যন্ত বিটলসের একমাত্র রিঙ্গো স্টার ই কনসার্টে যোগ দিতে সক্ষম হন।

এছাড়াও প্রথম আহ্‌বানে সাড়া দিয়েছিলেন বিল প্রেস্টন, লিওন রাসেলও। একে একে যোগ দেন বব ডিলান, জোয়ান বায়েজ, এরিক ক্ল্যাপটন, ওস্তাদ আলী আকবর খান, আল্লা রাখা খাঁ, হ্যারিসনের নতুন ব্যান্ড দল ব্যাড ফিঙ্গার এর অন্যান্যরাও।

বিটলস ভেঙে যাওয়ার পর এই অনুষ্ঠান ই ছিলো হ্যারিসনের সরাসরি অংশগ্রহণ করা প্রথম অনুষ্ঠান। এরিক ক্ল্যাপটনও এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে প্রায় ৫ মাস পর কোনো লাইভ প্রোগ্রামে গান গাইলেন, বব ডিলানও ১৯৬৯ সালের পর প্রথমবারের মতো কনসার্টে এলেন।

২৬ জুলাই এই কনসার্টের মহড়া শুরু হয় নিউইয়র্কের নোলা স্টুডিওতে। ১ আগস্ট ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে মূল অনুষ্ঠানের দৃশ্য শুরু হয় রবি শঙ্কর এবং আলী আকবর খান এর ৯০ সেকেন্ডের একটি নাতিদীর্ঘ প্রস্তুতিমূলক সঙ্গীতের মধ্য দিয়। শুরুতেই পণ্ডিত রবিশংকর এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, “প্রথম ভাগে ভারতীয় উপমহাদেশীয় সংগীত থাকবে। এর জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন। আমাদের বাদন শুধুই সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনৈতিক নই। বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে।”

অনুষ্ঠানে তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লা রাখা এবং তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী। গিটারে মন ভরিয়েছেন এরিক ক্ল্যাপটন, ক্লস ভোরম্যান, কার্ল র‍্যাডলি, ডন প্রিস্টন। আর অসাধারণ ড্রামস বাজিয়েছেন জিম কেল্টনার ও রিঙ্গো স্টার।

এককভাবে জর্জ হ্যারিসন সাতটি ও বব ডিলান চারটি গান গেয়েছিলেন। আর হ্যারিসন ও ডিলান মিলে গেয়েছেন একটি গান। রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেছিলেন। লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান- বাংলাদেশ।

প্রথমে পরিকল্পনা ছিলো একটি কনসার্ট হবে। কিন্তু দর্শক-শ্রোতাদের বিপুল সাড়া পাওয়ায়, সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার উপস্থিতি হয়। পরে অনুষ্ঠানসূচি ঠিক রেখে একই দিনে আরও একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান করা হয়েছিলো।

অপরাহ্ন ও সান্ধ্য; উভয় অনুষ্ঠানের গানগুলো রেকর্ড করা হয়। অনুষ্ঠানের চিত্র এবং জর্জ হ্যারিসনের বাছাই অনুযায়ী অনুষ্ঠানে গাওয়া গানগুলো নিয়ে ১৯৭২ সালে একটি সিডি প্রকাশ পায়।

কনসার্ট ও অন্যান্য অনুষঙ্গ হতে প্রাপ্ত অর্থ সাহায্যের পরিমাণ ছিলো প্রায় ২,৪৩,৪১৮.৫১ অর্থাৎ প্রায় আড়াই লক্ষ ডলার। যা পরবর্তীতে ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ব্যয়ীত হয়।

তবে এ্যালবামের চড়া দাম নিয়ে এবং এ্যালবাম হতে প্রাপ্ত অর্থ বাংলাদেশের শরণার্থী তহবিলে জমা দেয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিলো। ‘লস এঞ্জেলস টাইমস’ ম্যগাজিনে ২ জুন, ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ অনুযায়ী, ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ত্রাণকার্যের জন্য প্রায় ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করা হয়। তবুও, কনসার্ট আয়োজকরা কর-মুক্তির জন্য আবেদন না করার কারণে, তহবিলের অর্থগুলো প্রায় ১১ বছর আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংস্থার একাউন্টে আটকে ছিলো।

জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন ‘জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ’ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অলিভিয়া হ্যারিসন প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসেছিলেন। সেই সফরে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটের হাওর অঞ্চল ও ঢাকার দরিদ্র শিশু-কিশোরদের জন্য কিছু কার্যক্রমের পরিকল্পনা করে যান। বছরের পর বছর ধরে তিনি তাঁর প্রয়াত স্বামীর শুরু করা মানবিক কার্যক্রমগুলো অব্যাহত রেখেছেন, বর্তমানে যে কাজের সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশের শিশুরাও।

জর্জ হ্যারিসন এর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আই, মি, মাইন’ এ লিখেছেন, “মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে আমরা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমরা যখন কনসার্টের প্রস্তুতি নিচ্ছি, মার্কিনীরা তখন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। এখনো বাঙালি রেস্তোরাঁয় এমন সব ওয়েটারের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যাঁরা বলেন, “ওহ্, মিস্টার হ্যারিসন, আমরা যখন জঙ্গলে লড়াই করছিলাম, তখন বাইরে কেউ আমাদের কথা ভাবছে, এটা জানাটাও আমাদের জন্য ছিল অনেক কিছু।”

সহায়ক তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া, প্রথম আলো (১২ ডিসেম্বর, ২০১৬)

লেখকঃ ফারহান রাকিব ইমন

বিবিএ,এমবিএ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!