সাবেক সন্দ্বীপ থানার ওসি শাহজাহানের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

0 ৩০০,৩৩৩
একে একে গর্ত থেকে যখন থলের বিড়াল বের করছিল দুর্নীতি দমন কমিশন তখন জানা গেল ওসি প্রদীপের স্ত্রীর মতো চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) ও বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ চট্টগ্রাম রিজিয়নের পরিদর্শক শাহজাহানের(৫৪)স্ত্রী ফেরদৌসী আকতারও একই কৌশল অবলম্বন করে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।অর্থাৎ স্বামীর পেশাগত প্রভাব প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে ফেরদৌসী সম্পদ অর্জনের খাত হিসেবে মৎস খামারকেই হাতিয়ার হিসেবে দেখিয়ে আসছিলেন।
২০১৭ সালে দুদকে জমা পড়া একটি অভিযোগের দীর্ঘ তদন্ত শেষে লোহাগাড়া থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি)ও বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ চট্টগ্রাম রিজিয়নের পরিদর্শক শাহজাহান ও তার স্ত্রী(৫৪) ফেরদৌসীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।এতে প্রধান আসামি করা হয়েছে ওসি শাহজাহানের স্ত্রী ফেরদৌসী বেগমকে।দুদকের দায়ের করা মামলায় তারা মৎস্য খামারকে হাতিয়ার করে যে সম্পদ অর্জন করেছেন বলে জানিয়েছেন সেই মৎস খামারের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।বৃহস্পতিবার(২৮ জুলাই)দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এ মামলাটি দায়ের করেন দুদকের উপ-পরিচালক আতিকুল আলম।
দুদকের উপ-পরিচালক আতিকুল আলম সিভয়েসকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।তিনি বলেন,অসৎ উদ্দেশ্যে একে অপরের সহযোগিতায় অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার,দুর্নীতি দমন কমিশনে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে এক লাখ ৭১ হাজার ৭৩৬ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করে মিথ্যা তথ্য প্রদান,এক কোটি ৪৮ লাখ চার হাজার ৪১৩ টাকার সম্পদ স্থানান্তর,হস্তান্তর ও রূপান্তর করে ভোগ দখলে রাখার অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তিনি বলেন,তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন,২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭(১) ধারা,মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন,২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা,১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২)ধারাসহ দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।
জানা গেছে ওসি শাহজাহানের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে দুদকে জমা পড়া একটি প্রাথমিক অভিযোগ তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা মিলায় ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ ওসি শাহজাহান ও স্ত্রী ফেরদৌস আক্তারের পৃথক পৃথক সম্পদ বিবরণী দাখিলের আদেশ জারি করার সুপারিশ করা হয়।পরে একই বছরের ২৪ মার্চ ফেরদৌস আক্তারের সম্পদ বিবরণী দাখিলের আদেশ জারি করে দুদক।যা তিনি গ্রহণ করেন ২৮ মার্চ।একই বছরের ১৭ এপ্রিল দুদকে সম্পদ বিবরণী জমা দেন ফেরদৌস আক্তার।
সেই বিবরণ যাচাইয়ের জন্য দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়।টিমে দাখিল করা প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামি ফেরদৌসী আকতারের দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ৩ কোটি ২১ লাখ ৮৬ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য দিয়েছেন।তবে তার স্বামীর কাছ থেকে দান হিসেবে প্রাপ্ত ৪৩ লাখ ১০ হাজার ৮৬৭ টাকার সম্পদ বাদ দিয়ে ঘোষিত স্থাবর সম্পদ মোট ২ কোটি ৭৮ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৩ টাকা।এছাড়া দুদক যাচাইকালে তার নামে মোট ২ কোটি ৮০ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬৭ টাকার স্থাবর সম্পদ পেয়েছে।এছাড়া তিনি তার দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে নিজ নামে মোট ৪২ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩১ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দেন।সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে তার নামে ৪২ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩১ টাকার অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায়।অর্থাৎ,দান বাদে তিনি তার নামে সর্বমোট ৩ কোটি ২১ লাখ ৪০ হাজার ৬৪ টাকা সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দেন।যাচাইকালে তার নামে সর্বমোট ৩ কোটি ২৩ লাখ ১১ হাজার ৭৯৮ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায়।
এক্ষেত্রে আসামি ফেরদৌসী আকতার কর্তৃক দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৩৪ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য অসৎ উদ্দেশ্যে গোপনপূর্বক মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন।উল্লেখ্য,১ লাখ ৭১ হাজার ৭৩৪ টাকা তিনি চট্টগ্রাম জেলার খুলশী থানার লালখান বাজার পরশ মঞ্জিল,১৪ নং হাইলেভেল রোড এলাকায় নির্মিত বাড়ি নির্মাণ ব্যয় বাবদ গোপন করেছেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে,ফেরদৌসী আকতার ২০০৬-০৭ কর বছর থেকে ২০২০-২১ কর বছর পর্যন্ত গৃহসম্পত্তির আয়,বৈদেশিক রেমিটেন্স,ব্যবসার আয় ও অন্যান্য উৎস বাবদ সর্বমোট ২ কোটি ৪৩ লাখ ৫১ হাজার ৪২৭ টাকা বৈধভাবে আয় করেছেন।তবে তিনি তার আয়কর রিটার্নে পোল্ট্রি খামার এবং মৎস্য খামার থেকে ২০১৫-১৬ করবর্ষে ১০ লাখ টাকা,২০১৬-১৭ করবর্ষে ৪৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা,২০১৭-১৮ করবর্ষে ৫১ লাখ টাকা,২০১৮-১৯ করবর্ষে ১৮ লাখ ৭২ হাজার ৬৮৫ টাকা,২০১৯-২০ করবর্ষে ৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫০ টাকাসহ মোট ২ কোটি ২৯ লাখ ৩০ হাজার ৭৩৫ টাকা আয় প্রদর্শন করেছেন।
মামলার বিররণীতে বলা হয়েছে,কিন্তু বর্ণিত ব্যবসা সম্পর্কিত ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া অন্যকোনো রেকর্ডপত্র যেমন-সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে ব্যবসা করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতিপত্র,মৎস্য এবং পোল্ট্রি খামারে মিটার সংযোগের শুরু থেকে অদ্যাবধি যাবতীয় রেকর্ডপত্র এবং পরিবেশ ছাড়পত্র,খামারের লেনদেন সংক্রান্তে ব্যাংক স্টেটমেন্ট,মালামাল ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্তে চালান-বিল ভাউচার সংক্রান্ত কোনো প্রামাণ্য রেকর্ডপত্র পাওয়া যায়নি।তাই তার প্রদর্শিত ওই আয় গ্রহণযোগ্য নয়।
ফেরদৌস তার স্বামী ওসি শাহজাহানের সহযোগিতায়,ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি ও ঘুষের মাধ্যমে অর্জিত অপরাধলব্ধ অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরপূর্বক ভোগ দখলে রাখার খারাপ উদ্দেশ্যে পোল্ট্রি ও মৎস্য ব্যবসার আয় দেখিয়ে ২ কোটি ২৯ লাখ ৩০ হাজার ৭৩৫ টাকা ভুয়া আয় প্রদর্শন করেছেন।
আরও জানা গেছে,ফেরদৌসী আকতারের পারিবারিক ব্যয়,কর পরিশোধ ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ মোট খরচ ৫৪ লাখ ৯৩ হাজার ৮০৪ টাকা।এছাড়া তাদের যৌথ নামে উত্তরা ব্যাংক লালখান বাজার শাখার বাড়ি নির্মাণের জন্য গ্রহণ করা ১২ লাখ টাকা ঋণের সুদ হিসেবে মোট ৭ লাখ ৩৪ হাজার ২৭০ টাকা পরিশোধ করেছেন।তার অংশের পরিমাণ ৩ লাখ ৬৭ হাজার ১৩৫ টাকা, যা তার খরচ হিসেবে গণ্য হবে।এছাড়া তিনি মাইক্রোবাস কেনার জন্য ঢাকা ব্যাংক সিডিএ এভিনিউ শাখা থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণের সুদ হিসেবে মোট ২ লাখ ৯৯ হাজার ৭৯৫ টাকা পরিশোধ করেছেন।ওই ৩ খাতে তার সর্বমোট খরচ ৬১ লাখ ৬০ হাজার ৭৩৪ টাকা।
সংগৃহীত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ফেরদৌসী আকতার তার স্বামী শাহজাহানের সহযোগিতায় ২ কোটি ৮০ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬৭ টাকার স্থাবর ও ৪২ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩১ টাকার অস্থাবরসহ সর্বমোট ৩ কোটি ২৩ লাখ ১১ হাজার ৭৯৮ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। একই সময়ে তিনি মোট ৬১ লাখ ৬০ হাজার ৭৩৪ টাকা পারিবারিক ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয় করেছেন।অর্থাৎ ব্যয়সহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৭২ হাজার ৫৩২ টাকা।ওই সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তার বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া যায় ২ কোটি ৩৬ লাখ ৬৮ হাজার ১১ টাকা।এক্ষেত্রে ফেরদৌসী আকতার ১ কোটি ৪৮ লাখ ৪ হাজার ৪১৩ টাকার সম্পদ তিনি তার স্বামী শাহজাহান কর্তৃক অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ স্থানান্তর হস্তান্তর ও রূপান্তর করে ভোগ দখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!